সম্প্রতি ফেসবুকে একটি মজার পোস্ট ভাইরাল হয়েছে যেখানে দেখা যায় “কফিলের বড় ছেলে” শিরোনামে সান্ডা নিয়ে রসিকতা করা হয়েছে। যদিও এটি কৌতুকপূর্ণভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে, তবে বাস্তবে সান্ডা (আরবি: Dhabb) সৌদি আরবসহ মধ্যপ্রাচ্যে অত্যন্ত জনপ্রিয় একটি হালাল খাবার। চলুন জেনে নেওয়া যাক সান্ডা কী, এর পুষ্টিগুণ ও উপকারিতা এবং কেন সৌদিরা একে এত পছন্দ করেন।
সান্ডা কী?
বাংলাদেশে যেটিকে ‘সান্ডা’ বলা হয়, তা আসলে মরুভূমিতে বসবাসকারী একটি বিশেষ প্রজাতির সরীসৃপ, যা বৈজ্ঞানিকভাবে Uromastyx নামে পরিচিত। আরবিতে একে ‘ধাব’ (ضَبّ) বলা হয়। এটি দেখতে কিছুটা ইগুয়ানার মতো হলেও খাদক (শাকাহারী) এবং তুলনামূলক শান্ত প্রকৃতির হয়ে থাকে।
সৌদিতে সান্ডার জনপ্রিয়তা কেন?
মধ্যপ্রাচ্যের মরুভূমি অঞ্চলে সান্ডা বহু শতাব্দী ধরে খাদ্য হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। এর কয়েকটি কারণ হলো:
✅ প্রোটিনসমৃদ্ধ খাদ্য: সান্ডার মাংস উচ্চমানের প্রোটিন সরবরাহ করে যা মরুভূমির শুষ্ক পরিবেশে কর্মক্ষমতা ধরে রাখতে সহায়তা করে।
✅ ঔষধিগুণে ভরপুর: আরবদের বিশ্বাস অনুযায়ী সান্ডার মাংস যৌনশক্তি বৃদ্ধিতে কার্যকর এবং শারীরিক দুর্বলতা দূর করে।
✅ প্রাচীন বেদুইন সংস্কৃতির অংশ: সৌদি আরবে সান্ডা খাওয়ার ঐতিহ্য মূলত বেদুইনদের জীবনধারা থেকে এসেছে যারা শিকার করে প্রকৃতির সঙ্গে একাত্ম হয়ে বাঁচতেন।
✅ হালাল সার্টিফাইড: সান্ডাকে ইসলামে হালাল ঘোষণা করা হয়েছে। বিখ্যাত ইসলামী স্কলার ইবনে আব্বাস (রাঃ) বর্ণনা করেছেন, রাসূলুল্লাহ (সঃ) সান্ডা নিজে না খেলেও সাহাবীদের তা খেতে নিষেধ করেননি। সুতরাং এটি হালাল হিসেবে স্বীকৃত।
সান্ডা খাওয়ার উপকারিতা
বিভিন্ন গবেষণা ও প্রাচীন অভিজ্ঞতার আলোকে সান্ডা খাওয়ার বেশ কিছু উপকারিতা রয়েছে:
১. শক্তিবর্ধক ও পুষ্টিকর
সান্ডার মাংসে রয়েছে প্রচুর প্রোটিন, আয়রন ও মিনারেল যা শারীরিক শক্তি বাড়াতে সহায়ক। যারা দৈহিক পরিশ্রম বেশি করেন তাদের জন্য এটি কার্যকর।
২. যৌনস্বাস্থ্যে উপকারিতা
আরব দেশে প্রচলিত বিশ্বাস অনুযায়ী, সান্ডার মাংস ও চর্বি যৌনস্বাস্থ্য উন্নত করতে সাহায্য করে। এটি এক প্রকার প্রাকৃতিক এফ্রোডিসিয়াক হিসেবে বিবেচিত হয়।
৩. হাড়ের গঠন মজবুত করে
সান্ডার মাংসে রয়েছে ক্যালসিয়াম ও ফসফরাস যা হাড়ের গঠন মজবুত রাখতে ভূমিকা রাখে। বয়স্ক ও হাড়ের সমস্যায় আক্রান্তদের জন্য এটি উপকারী হতে পারে।
৪. রক্তস্বল্পতা দূর করে
সান্ডার মাংসে প্রচুর পরিমাণে আয়রন থাকার কারণে এটি অ্যানিমিয়া বা রক্তস্বল্পতা প্রতিরোধে কার্যকর।
সান্ডা রান্নার পদ্ধতি ও স্বাদ
সৌদিতে সান্ডাকে সাধারণত কাবাব, ঝলসানো বা ঝোল করে রান্না করা হয়। অনেক সময় মরিচ, জিরা, গোলমরিচ, দারুচিনি দিয়ে মশলাদার করে ভুনা করা হয়। এর স্বাদ কিছুটা মুরগির মাংসের মতো হলেও ঘন ও গাঢ় হয়।
বাংলাদেশে সান্ডার ব্যবহার ও লোকজ বিশ্বাস
বাংলাদেশে সান্ডাকে অনেকে গায়ের মালিশের তেল তৈরি করতে ব্যবহার করেন। স্থানীয়দের বিশ্বাস, সান্ডার চর্বি বাত, ঘাড় ব্যথা, ও কোমর ব্যথার জন্য খুবই উপকারী। গ্রামগঞ্জে এখনো সান্ডার চর্বি দিয়ে তেল তৈরি করে মালিশ করা হয়।
সান্ডা: হালাল অথচ ভুল বোঝাবুঝির শিকার
অনেকে ভুল করে সান্ডাকে হারাম মনে করলেও ইসলামিক স্কলারদের মতে এটি পুরোপুরি হালাল। রাসূলুল্লাহ (সঃ) সান্ডা খেতে নিষেধ করেননি। বরং হাদিস শরীফে আছে যে, খালিদ ইবনে ওয়ালিদ (রাঃ) রাসূলুল্লাহর সামনে সান্ডা খেয়েছিলেন।
কেন কফিলের বড় ছেলেরা সান্ডা পছন্দ করে?
সৌদি আরবের কফিল (প্রতিপালক) পরিবারগুলোর ছেলেরা সান্ডাকে সুস্বাদু ও পুষ্টিকর হিসেবে বিবেচনা করেন। সান্ডা খাওয়া তাদের কাছে মরুভূমির ঐতিহ্যবাহী খাবারের অংশ। বিশেষ করে তারা মনে করেন এটি পুরুষদের শারীরিক সক্ষমতা ও শক্তি বৃদ্ধি করে।
সান্ডা শুধু একটা মজার ফেসবুক মিমের বিষয় নয়, বরং এটি হাজার বছরের পুরনো আরব ঐতিহ্যের অংশ। পুষ্টিগুণে ভরপুর ও হালাল এই খাবার মধ্যপ্রাচ্যের পাশাপাশি বিশ্বজুড়ে আগ্রহী ভোজনরসিকদের কাছে জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। তাই সান্ডা নিয়ে কৌতুক করলেও, এর পুষ্টিগুণ ও উপকারিতা অনস্বীকার্য।